Rose Good Luck নো-ম্যান্স ল্যান্ড (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-২) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১০ মার্চ, ২০১৫, ০৩:৫৪:৫৫ দুপুর

' আমি জন্মাতে চাইনি ক্লীবদের পরিহাসে

নক্ষত্রের ঊষর ভূমিতে

লুব্ধকের অহংকারী তপ্ত নিঃশ্বাসে

কিংবা অশান্তির আগুনে পোড়া নাগরিক বন্যতায়।

অথচ আমি আছি মূর্খতার দহনে দগ্ধ কয়লায়,

এসিডের জ্বলনে ব্যথার চিৎকারে,

টবে কাঁটাছাটা বয়স্ক বনসাইয়ের দুঃখ ছুঁয়ে

রেলিং ঘেরা ব্যালকনিতে নিষিদ্ধ আকাশ হয়ে। ' [ রুকসানা হকঃ মধ্যরাতের নদীর শব্দ ]

এ পর্যন্ত পড়েই মন ক্রমশঃ খারাপের সূচকে পারদের নিম্নগতি লাভ করাতে রায়হান ওর টেবিলের উপর বইটি রেখে দিলো। ভারতের অনগ্রসর একটি রাজ্যের সীমান্ত থেকে মাত্র দশমিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে এই স্কুল ও কলেজটি। আসলে এটি একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বারোশো' ছাত্রছাত্রীর এক বিশাল ক্যাম্পাস। এর স্কুল অংশটি এম.পি.ও ভুক্ত। কিন্তু কলেজ এখনো হয়নি। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে রায়হান এখানে যোগ দেবার আগে মাত্র দুটো এইচ.এস.সি ব্যাচ শিক্ষা সমাপ্ত করে চলে গেছে। এদের পাসের হার খুবই খারাপ। এম.পি.ও ভুক্তির জন্য ন্যুণতম যোগ্যতা অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এর কলেজ অংশের জন্য।

রায়হানের জন্য বেশ একটি চ্যালেঞ্জই বটে। সদ্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়া এক যুবকের জীবনের প্রথম চাকুরি এই বিশাল পোষ্টটিতে!

চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই।

এ এক অদ্ভুদ অনুভূতি! বুকের গভীর থেকে রক্ত কণিকার উত্তপ্ত স্ফুটন আর শিরায় শিরায় দ্রুত প্রবাহের দ্বারা হৃদয়কে উদ্বেলিত করে তোলা! আসলেই উপলব্ধির এক নতুন মাত্রা যেন।

অধ্যক্ষের যে চেয়ারটিতে এখন রায়হান এই পড়ন্ত বিকেলে বসে আছে, প্রথম দিনের সেই প্রথম মুহুর্তটির কথা মনে পড়ে। নিজের বাবার বয়সী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং অন্য সিনিয়র শিক্ষক ও প্রভাষকদের ভেতর দিয়ে দুরু দুরু বুকে সকলের কাছে-দূরে চাহনির তীব্রতায় আলোকিত নিজেকে কিভাবে যে সেদিন এই আসনটিতে টেনে এনেছিল! আজ ভাবলে এখনো সেই শিহরণ জেগে ওঠে হৃদয়ে... সারা দেহে।

পুরনো ভারী কাঠের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরে পুরু কাঁচ দেয়া। কবিতার বইটি এক পাশে সাথে একটি খোলা ডায়েরি নিয়ে নির্বাক পড়ে আছে। কিন্তু কত শত সহস্র কথার ফুলঝুরি রয়েছে এর পাতায় পাতায়! বইটি বন্ধ করার আগে লাল রিবনটি দিয়ে মার্ক করে রাখতে ভুললো না অর্ধেক পড়া প্রিয় কবিতাটি।

শিক্ষক প্রভাষকেরা সবাই চলে গেছেন।

শেষ বিকেলের লালিমা বেলা শেষের সমাপ্তি ঘষনা করবে অল্পক্ষণ পরেই। আবার সেই একাকীত্ব! বিশাল এক প্রান্তরে জনমানবহীন হবার টুকরো টুকরো দমবদ্ধ অনুভূতি... কাঁটা বেঁধা কিছু জ্বালাময়ী মুহুর্ত রায়হানকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে আসছে।

আঁধারকে এখন কেন জানি বেশ ভালো লাগে। অনেক নিজের মনে হয়। কাছের ভালো লাগা কেউ... পাশের বাড়ির চিরচেনা আটপৌরে বসনের মেয়েটির মতো!

কাছের মানুষগুলো কতটা কাছে ওর?

দূরে হলেও বা কত দূরে?

এরকম কাছে-দূরে মুহুর্তগুলো কতটা সাধারণ? কিংবা অসাধারণ হলেও কতটুকু?

চৌধুরী এসে অধ্যক্ষের রুমের সামনে দাঁড়ায়। হাতের চাবির গোছার চাবিগুলোর নিজেদের ভেতরের সংঘর্ষের দরুন সৃষ্ট শব্দে রায়হানের ভাবনা থেকে যায়। সে সামনে তাকায়। নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। চৌধুরী দরোজায় তালা লাগিয়ে দেয়।

নিজের থাকার রুমটিতে এসে দেখে হ্যারিকেনের ডিম করা আলো। পরিষ্কার চিমনি। কিশোরীর চোখের মতো চকচক করছে। সারা বিকেল ধরে চৌধুরী এই কাজটি করে খুবই যত্নের সাথে। দেখে চোখের শান্তি হয়। কেমন ঘুম ঘুম ভাব আসে।

নিজের 'পোষাকী' পোশাক ছেড়ে একজন অধ্যক্ষ রায়হানে পরিণত হয়। এরপর মিনি রেকর্ডারটি সাথে নিয়ে রুম থেকে বের হয়। বারান্দা পেরিয়ে মাঠে নামে। সারাদিনের জুতোয় আবদ্ধ পা দুটি মুক্তির আনন্দে স্পঞ্জের বুকের তলায় আরো গভীরে ছন্দময় পদক্ষেপের সুখানুভূতিতে বিলীন হতে থাকে।

পুকুর পাড়ে একটি ছাপড়া ঘর। ছনের চাল এবং বাঁশের বেড়ার এই ঘরটির ভিতরে মাছের খাবার ও জাল নিয়ে রফিক থাকে। এ ও বয়স্ক। কিন্তু ছেলে বুড়ো সবার কাছেই সে স্রেফ 'রফিক'। এরকম কিছু মানুষ সব যায়গায়ই থাকে। এরা অপমান এবং গ্লানি নিজেদের পরিচ্ছদ ভেবেই একধরণের দুঃখবিলাসের ভিতরে বাস করতে ভালোবাসে।

এই দীঘিটি এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সম্পত্তি। প্রতি পাঁচ বছর পর পর টেন্ডারের মাধ্যমে লীজ দেয়া হয়। টাকাগুলো প্রতিষ্ঠানের ফাণ্ডে জমা হয়। শহরের এক ভদ্রলোক গত দুটি টার্মে বেশী দরপত্রের জন্য পর পর দু'বার এই পুকুরটি লীজ নিতে পেরেছেন। এখানে সাদা মাছ চাষ করেন। বেশ মুনাফা ই হয়। এই ব্যবসাটি তিনি বেশ ভালোই বুঝে গেছেন।

পুকুর পাড়ে এসে রফিককে হাঁটু পানিতে দাঁড়ানো দেখে রায়হান। স্টিলের একটি বোট পাড়ে রশি দিয়ে বাঁধা। সেটি খুলে রশিটি বটে রাখছে সে। এখন এই বোটে করে সারা দীঘির মাছেদের জন্য খাবার দিতে যাবে। রফিক এই পুকুরটির কেয়ারটেকার। মাছের খাবারের প্রচন্ড বদ গন্ধওয়ালা এই বোটের পাশে থাকতে ওর কেমন লাগে? চকিতে এই ভাবনাটি মনে আসে রায়হানের।

প্রথম দিকে তো রায়হানের নিজেরও অসহ্য লাগতো।

এখন ধীরে ধীরে অভ্যেস হয়ে গেছে।

হ্যা, এমনটি ই হয়।

চলার পথে এমন অনেক কিছুই আমাদের সামনে 'প্রথমবারের মতো বিব্রতকর' হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু ঐ যে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া...

সময় ই সব কিছু মানিয়ে নেবার সক্ষমতা দিয়ে দেয়।

সময় মনে হওয়াতে রায়হান নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু সময় দেখে না। এরকম অনেক কিছুই আজকাল সে তাকালেও দেখতে চায় না। না কি দেখতে পায় না?

একটা কাঠের পুরনো জীর্ণ চেয়ারে বসে রায়হান মাছেদের খাবার দেয়া দেখতে থাকে। রফিক ঘুরে ঘুরে বিশাল দীঘিতে মাছের খাবার ফেলছে। কালো জলের ভিতরে আলোড়ন তুলে মাছগুলো পোষাপ্রাণীর মতো কেমন লোভী আচরণ করছে দেখতে পেলো। রফিক যেন ওদের কতো আপন! ওকে মাছেরাও যেন কিভাবে চিনে গেছে। ওর দ্বারা কিছু পাওয়া যায়- হয়তো এমন কোনো বোবা অনুভূতি মাছগুলোর নিউরনে হ্যা-বোধক অনুভবের সিগন্যাল পাঠায়। আসল কথা হল, ওপরকে দিয়ে গেলে তাঁরা সবসময়ে এই প্রাপ্তির জন্য প্রদানকারীকে চিনে নেয় বেশ ভালোভাবেই।

রায়হান আকাশের দিকে তাকায়। মেঘে ঢাকা চাঁদ। এর ভিতরেও কিছু আলো ঠিকই বের হচ্ছে। রফিকের কাজ শেষ হলে বোটটিকে পাড়ের অল্প পানিতে নিয়ে এসে ডুবিয়ে দেয়। ভালোভাবে ধুয়ে দুর্গন্ধ দূর করার চেষ্টা করে। এরপর আবার পানিতে ভাসিয়ে নিজের অতিরিক্ত গামছাটি দিয়ে বোটে বসার যায়গার পানি মুছে ফেলে। এসময় হ্যারিকেন হাতে চৌধুরী আসে। হাতে অ্যালুমিনিয়ামের ছোট্ট বালতিটি।

রফিক এখন রায়হানকে ঘন্টাখানিক বতে করে সারা দীঘিতে ঘুরে বেড়াবে। রোজকার এই রুটীন।

বোট দীঘির পাড় থেকে ক্রমশঃ দীঘির গভীরে সরে যাচ্ছে। স্কুল বারান্দার দিকে হাতে হ্যারিকেনের ম্লান আলো নিয়ে ফিরে চলা চৌধুরী আরো দূরে রায়হানের দৃষ্টির সীমানায় ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। একসময় শুধু আলোটুকুই দৃষ্টিগোচর হয়।

একজন মানুষ কখন আলো হয়ে যায়?

রায়হানের বাবা ওকে আলো হবার প্রশিক্ষণ নিতেই এই অজ পাড়া গাঁয় চাকরি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু রায়হান কি আলো হবার সেই প্রয়োজনীয় শিক্ষাটুকু এই বিগত ছয় মাসে নিয়েছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে রায়হান।

ওদের দুজনের কাছে 'আলো'র সংজ্ঞা ই ভিন্ন। আর জীবনে এই প্রথম নিজের জনকের সাথে ওর ভাবনা চিন্তায় এক বিরাট পার্থক্য দেখতে পায়। দুই প্রজন্মের 'প্রজন্মগত ব্যবধান'? বাবার চিন্তার সাথে রায়হানের নিজস্ব ভাবনা দৃশ্যমান এক জগতে প্রকট না হলেও নিজের একান্ত জগতটিতে আলোড়ন তোলে।

আবারো মন খারাপের দিকে যেতে থাকে। মন খারাপের এক অসুখ ই হয়ে গেলো নাকি!

বোটে চুপচাপ বসে থাকা রায়হান ভাবে। ওর দুঃখগুলো জোনাকীর আলো হয়ে রাতের আঁধারে গভীর দীঘির মাঝে রায়হানকে পথ নির্দেশের অক্ষম প্রায়াস চালায়। কিন্তু সে মানুষ আলো হতে এসে নিজের ভেতরের আলোয় পথ চলতে জানে না, সে অপর কোনো কিছুর আলোয় কি পথ চলবে?

চললেও কতটুকু চলতে পারবে... এভাবে কতটা পথ পেরোনো যায়?

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

৭৪৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

308224
১০ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৫:১৩
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু শ্রদ্ধেয় সুহৃদ মামুন ভাইয়া।
লুব্ধকের অহংকারী তপ্ত নিঃশ্বাসে

কিংবা অশান্তির আগুনে পোড়া নাগরিক বন্যতায়।

অথচ আমি আছি মূর্খতার দহনে দগ্ধ কয়লায়,

এসিডের জ্বলনে ব্যথার চিৎকারে,

টবে কাঁটাছাটা বয়স্ক বনসাইয়ের দুঃখ ছুঁয়ে

রেলিং ঘেরা ব্যালকনিতে নিষিদ্ধ আকাশ হয়ে।

বিশ্লেষণসহ চমৎকার লাগলো। জাজাকাল্লাহু খাইর।

Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up Bee Bee Bee Bee Bee m/ m/ m/ m/ m/ m/ m/
১১ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৮:৩৭
249360
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম প্রিয় আপুজি।
সুন্দর অনুভূতি রেখে সাথেই রইলেন, অনেক ভালো লাগছে।
বারাকাল্লাহু ফীহ।Good Luck Good Luck
308225
১০ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৫:১৬
সন্ধাতারা লিখেছেন : লেখিকা কী আত্মীয় ভাইয়া?
১১ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৮:৪০
249361
মামুন লিখেছেন : না, ওনাকে আমি চিনি না। এই বইমেলায় ওনার কবিতার বইটি কিনেছিলাম। দুর্দান্ত লিখেন। আর নতুন লেখকদেরকে একজন নতুন লেখক হিসেবে সমর্থন করা আমার কাজ মনে করেছি। এজন্যই আমার লেখায় তিনি বেশ কয়েকবার চলে এসেছেন। আপনি, সাদিয়া মুকিম, মাহবুবা সুলতানা লায়লা সহ অন্য যারা লিখছেন, আপনারাও চমৎকার লিখেন। আমি ভালো লেখক-লেখিকা এবং কবিদের অনেক সম্মান করি।
ভালো থাকুন।
শুভ সকাল।Good Luck Good Luck
308237
১০ মার্চ ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১৭
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : চলার পথে এমন অনেক কিছুই আমাদের সামনে 'প্রথমবারের মতো বিব্রতকর' হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু ঐ যে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া.. কঠিন সত্য কথা! ভালো লেগেছে পড়ে! দেখি সামনে কি হয়.. Happy Good Luck Praying
১১ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৮:৪০
249362
মামুন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
ভালো থাকুন। শুভ সকাল।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File